বন্ধু

“তোর সাথে আমার কাট্টি…যা আর কোনদিন কথা বলবো না।আড়ি,আড়ি, আড়ি….যাব না তোর বাড়ি।”……. একদমে সবগুলো কথা বলেই উল্টো দিকে এক দৌড় দিল চারু।পিছন থেকে আমি ডাকলাম,” পাগলী শুনে তো যাবি কেন যে কলেজে এ আসি নি.. তোর জন্য একটা জিনিস বানিয়েছিলাম যে!দেখবি না?”…অমনি সে ধুম করে দাড়িয়ে পিছন দিকে ঘুরে তাকালো।…..
চারুকে আদর করে পাগলী ডাকতাম।পাগলীটা রেগে গেলে খুব সুন্দর লাগতো।গাল আর নাকের আগাটা ঘেমে টুকটুকে লাল হতো।
আস্তে আস্তে রাগে আমার কাছে এসে বললো “কি বানিয়েছিস,দেখা আমাকে “…শার্টের ভিতর থেকে একটা ছোট্ট বউয়ের পুতুল বের করে বললাম,” নে ধর্ .. এটা তুই। তোর জন্মদিনের উপহার।” পাগলীটা খুশিতে এখানেই লাফিয়ে উঠলো।একটু পর আবার মন খারাপ করে বললো,”কবি জানিস কাল রাতে ছেলেপক্ষ দেখতে এসিছিল রে।আমাকে নাকি ওদের পছন্দ হয়েছে! “কথাটা শুনেই আমার ভিতরটা কেঁপে উঠলো। মনে হচ্ছে জীবনটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
সবে মাত্র কলেজে পড়ি…. জন্মের পর থেকে এই পাগলীই আমার একমাত্র বন্ধু। অন্য কেউ যদি আমাকে ভুল করেও “কবির” না ডেকে “কবি” ডাকতো, তার আর রক্ষে ছিলো না।পাগলীর সাথে এক চোট হয়ে যেতো।পাগলীর সাথে আমার বন্ধুত্ব খুব গভীর। আমার সব স্মৃতিতে কোথাও না কোথাও পাগলীটা থাকবেই।এখন থেকে ওকে ছেড়ে থাকতে হবে ভাবতেই ভয় লাগে।অভিমান এ ওর বিয়েতেও যাই নি আমি।ওর পরে আমাকে কেউ কবি বলে ডাকেও নি।আর আমিও কাউকে পাগলী ডাকি নি। শুনেছিলাম পাগলীটার বর নাকি ভারতে থাকে..!এরপর আর খোঁজ পাই নি।
# আজ ৫০ বছর পরে…..!
আমার বয়স এখন ১৮ পেরিয়ে ৬৮তে চলে গেছে! বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখালেখি থেকে এখন কবি ই আমার পরিচয়। জীবনটা সাহিত্যেই কাটিয়ে দিয়েছি।বিয়ে করার সময়টুকু ও পাই নি।বাসায় আমি আর আমার কেয়ারটেকার হাবলু ছাড়া আর কেউ নেই।
হঠাৎ সকালে হাবলু এসে বললো “বাজান,একখান মাইয়া আপনের লগে দেখা করিবার চায়”আমি ভাবলাম হয়তো কোনো শিষ্য। বললাম” পাঠিয়ে দাও।”
ঘরে ঢুকেই মেয়ের প্রথম কথাটি ছিলো, “ভালো আছ কবি?” আমি চমকে উঠলাম!আমার পাগলীর পরে এই প্রথম কেউ আমায় কবি ডাকলো। মেয়েটার মুখটা দেখেও অদ্ভুত মায়া লাগছিলো। কি যেন একটা টানছিল ওর দিকে।
কথায় কথায় জানতে পারলাম মেয়েটা ভারত থেকে এসেছে।নাম লতা। বাংলাদেশ নিয়ে লিখতে চায়।৭দিনের জন্য এসেছে। ওর বাগদত্তা ওকে এসে নিয়ে যাবে ৭দিন পর।এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি চলে এসেছে। হাবলুকে ডেকে গেস্ট হাউজে ওর থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম।
মেয়েটাকে যত দেখি তত অবাক হই আমি।এতো মায়া ওর মধ্যে!! আমি ওকে বলেই বসলাম,”তোমার নামটা মায়া হলে বেশ মানাতো তোমার সাথে।”সে বলল,” আমার নাম আমার মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছে।আমার মেয়ের নাম তাহলে আমি মায়া রাখবো।”আমি একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম “তোমার মায়ের নাম কি তাহলে?”এই সময় একটা কল আসলো আর লতা উঠে চলে গেলো।মায়ের নাম অজানাই রয়ে গেল।
মেয়েটা বেশ প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, চঞ্চল… সারাবাড়ি মাথায় করে রেখেছিল যতদিন ছিল। আজ সন্ধ্যায় ওর বাগদত্তা এসে ওকে নিয়ে গেলো।আমার খুব খারাপ লাগছিলো। কেন জানি আমার ছোট্টবেলার হারিয়ে যাওয়া পাগলীটার কথা মনে হচ্ছিল বহু বছর পরে।লতা যাওয়ার আগে একটা চিঠি দিয়ে বললো,” কবি,আমি যাওয়ার আগে তুমি এটা খুলবে না।রাতে খুলে দেখবে।”রাতে শুয়ার আগে চিঠিটা নিলাম।
চিঠিতে লিখা ছিলঃ
“#কবি,
জীবনের কোনোকিছুই স্থায়ী নয়।কিছু জিনিস স্মৃতি হলেই বেশ লাগে।সব স্মৃতিই কি দুঃখ দেয় রে?জীবনে বাঁচতে হলে কিছু তো সোনালী স্মৃতি দরকার পরেই। আমাদের বন্ধুত্বটাও এমন একটা স্মৃতি ধরে নে!চারুর লতার হাত ধরেই না হয় স্মৃতির পাতায় আর একটু আবেগ ঢেলে দিলাম।
ইতি-
তোর পাগলী”
চিঠিটা পরে আমি স্তব্ধ, বিষন্ন, নির্বাক…শরীরটা খুব দুর্বল লাগছিলো। বেলকনির ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। ঘোলা চোখে পাগলী আর লতার চেহারাটা ভেসে উঠছে বারবার।
নিজের ভাগ্যের কাছে প্রশ্ন তুললাম….
এটা গল্প কেন হলো না??….💔🎨
More From Author
- None Found