স্বেচ্ছাবন্দির নামচা-পালামৌ পর্ব

অনেকদিন ধরেই বসে বসে ভাবছিলাম লকডাউন এর বন্দিদশা কাটাবার কি কি উপায় আমার হাতে রয়েছে।সত্যিকারের অকর্মন্য বিশেষণটা বোধহয় সানন্দে আমার পিছনে সাঁটিয়ে দেওয়া যায়।ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত ঘরের কাজ কোনোদিন কিছু করিনি – জানিও না।সময় কিভাবে যে কাটবে এটা ভেবে ভেবেই বন্দিত্বের বেশ কিছুদিন কাটিয়ে ফেললাম।অনন্ত অবসরে কিছু একটা করার তাগিদ আর গল্প শোনাবার অদম্য ইচ্ছে আমাকে কাগজ কলম নিয়ে বসিয়ে দিলো।
বসে তো পড়লাম – কিন্তু লিখি কি? একটাই তো নেশা -ভেবে রেখেছি সেটা নিয়েই বিবর্ণ অবসরের ক্যানভাসটাকে রং তুলি দিয়ে সাজিয়ে নেবো। ভাবছেন নেশাটা কি -না, যা ভাবছেন তা নয়।ছোট ছোট অজানা জায়গার সন্ধান করা, আর স্বপ্নে নয় – বাস্তবে সেখানে পৌঁছে যাওয়া- প্রকৃতিকে নিজের মতো করে পাওয়া – এই নেশাতেই মেতে রয়েছি আমি।কৈশোর, যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত।বন্ধুদের সাথে বেড়ানোর প্রচুর স্মৃতি রয়ে গেছে – সেগুলো বোধ হয় আজ হাতড়ে বের করার সময়- কতটা পারবো জানি না -অনেক কথা, অনেক স্মৃতিই হারিয়ে গেছে সময়ের সাথে। জঙ্গল আমায় টানে- বন্যেরা বনে সুন্দর -এই কারণেই বোধহয় কিছুটা বন্যতা আমার মধ্যে আজও আছে। জঙ্গলের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়- যতদূর মনে পরে ১৯৮০ সালে -পাড়ার রকের আর খেলার মাঠের বন্ধুদের সঙ্গে বেতলা নেতারহাট বেড়াতে যাওয়া। তখনও পৃথিবীটা ছোট হতে হতে বোকা বাক্সে বন্দি হয়নি- ইন্টারনেট কি বস্তু- তার কাজ কর্ম অন্তত ভারতবর্ষের লোকের কাছে সেভাবে পরিচিতি পায়নি। নিজের পকেটে আর ছজন বন্ধু মিলে চড়ে বসেছিলাম বর্ধমান থেকে দুর্গাপুরের বাসে।আজকের দুর্গাপুরের সঙ্গে তখনকার শিল্প শহরকে মিলিয়ে দিলে অবাস্তব হবে। কিছুই জানি না, চিনি না – বাস নামিয়ে দিলো একটা চৌমাথায় -লোককে জিজ্ঞেস করে জানলাম এটা গান্ধী মোড়।
যাহ বাবা – আমরা তো উঠবো রাঁচি যাওয়ার কালিকা বাসে- সেটা কোথা থেকে ছাড়ে? তারও উত্তর পাওয়া গেলো এক পান দোকানদার এর কাছে -যেতে হবে ভিড়িঙ্গি মোড়। আমাদের কাছে তখন সবই হিব্রু – কিন্তু যাবো কিভাবে ? ছজন সদ্যযুবা চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে লরি, টেম্পো যাকেই হাত দেখাই কেউ দাঁড়ায় না- কোনো বাসেরও দেখা নেই।এদিকে কালিকা ছাড়ার সময় এগিয়ে আসছে। উত্তেজনা আর ভয় – দুটো অনুভূতি একসাথে, কিন্তু কিছুই করার ছিল না তখন।ভগবান বোধহয় আমাদের দুর্দশায় সত্যি বিব্রত হয়েছিলেন – না হলে হঠাৎ উদয় হওয়া একটা সাদা অ্যাম্বাসেডরকে হাত দেখাতেই কেন সেটা দাঁড়িয়ে পড়বে? আজও সেই বয়স্ক ভদ্রলোকের মুখ মনে পড়ে- সহাস্য মুখে প্রশ্ন ছিল “কোথায় যাবে ইয়ং ম্যান রা ?” ঠেসে ঠেসে ছজন উঠেছিলাম ওনার গাড়িতে -আজ এই শরীরে বোধহয় কিছুতেই পারবো না।ভিড়িঙ্গি পৌঁছে কালিকা এক্সপ্রেসে উঠে তো পড়লাম -সে বাস আজও রাঁচি যায়। জানি না তার কোনো উন্নতি হয়েছে কিনা – তবে আমাদের পকেটের রেস্ত অনুযায়ী সেই তখন আমাদের কাছে স্বর্গ। বাসে বসার জায়গা পাইনি সবাই – আজ বোধহয় দুঃস্বপ্নেও দাঁড়িয়ে বাড়ি থেকে বেনাচিতি যাওয়ার কোথা ভাববো না আমি।
বাস চলছিল আপন গতিতে- চটুল হিন্দি গান আর বন্ধুদের সাথে ঠাট্টা তামাশায় দাঁড়িয়ে থাকার যন্ত্রনা বা পায়ের শিরায় টান (আজকের মতো) কোনোটাই অনুভব করছিলাম না।হঠাৎ মেজাজ হারালাম- পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ একজন আমার বেড়াতে যাওয়ার জন্য কদিন আগে কেনা নতুন জামাটা ছিঁড়ে দিলো।ফর ফর আওয়াজটা কানে আসতেই পেছন ঘুরেছিলাম – দেখলাম একজনের বত্রিশ বার করা অট্টহাসি।বুঝুন আমার অবস্থাটা – ছেঁড়া জামা নিয়ে এতটা রাস্তা কিভাবে যাবো, আর অপকর্মটি যিনি করলেন তিনি কিনা!!!!!!! কিন্তু কি আশ্চর্য্য, চারিদিকে তাকিয়ে দেখি -সবাই হাসছে, মায় আমার বন্ধুরা পর্যন্ত। অজান্তে হাতটা পিঠে চলে গিয়েছিলো – দেখলাম জামা আস্তই আছে। আজও কালিকার সেই বাস কন্ডাকটর এর কোথা মনে পড়ে- মুখ দিয়ে ভয়ঙ্কর আওয়াজ করে লোককে বিব্রত করে নির্ভেজাল মজা নেওয়া – আর কষ্টকর যাত্রায় সবাইকে আনন্দ দেওয়ার প্রচেষ্টা – সব মিলিয়ে একটা ছোটোখাটো হিউমার প্যাকেজ। বহুকষ্ট করে দীর্ঘ ছ সাত ঘন্টার ক্লান্তিকর সফরের পর শরীরটা তো রাঁচি পৌঁছলো -হাত পা বোধহয় আর শরীরের সাথে লেগে থাকার তাগিদ অনুভব করছিলো না। কিন্তু পকেট তো পরিশ্রম আর শরীরী অসহায়তার মূল্য বোঝে না। বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম ৪৮০ টাকা পকেটে নিয়ে- তার কিছুটা বাসভাড়ায় গেছে। রাঁচিতে থাকার রেস্ত নেই- আজই পৌঁছাতে হবে পালামৌ এর জঙ্গলে। খোঁজ খোঁজ- সবাই মিলে চষে ফেললাম বাসস্ট্যান্ড -মিললো এক trekker এর খোঁজ- দেহাতী এবং স্থানীয় মানুষজন নিয়ে সে তখন ফুঁসছে শেষ সন্ধ্যার দৌড় শুরু করার জন্য। ব্যাগপত্তর নিয়ে ছজন উঠে তো পড়লাম- ছোটবেলায় পড়েছিলাম “তিল ধারণের স্থান হয়তো আছে, কিন্তু মনুষ্য ধারণের স্থান বিন্দুমাত্র নাই”- trekker এর ভিতরের বাস্তব চরিত্র বোধহয় এর থেকেও খারাপ ছিল।যাদের trekker এ যাতায়াতের সামান্য অভিজ্ঞতা আছে, তারা বুঝবেন অন্ধকার জঙ্গলের রাস্তায় মুড়ির টিনের মতো ঝাঁকি খেতে খেতে – সে এক বিভীষিকার যাত্রা। স্বপনকুমারের ভাষায় “অন্ধকারের বুক চিরে ছুটে চলেছে তুফান মেইল”-চারিদিক নিঃস্তব্ধ, trekker ছুটছে-স্থানীয়রা টুকটাক কথাবার্তা চালাচ্ছে-আমাদের অবস্থা কহতব্য নয়-মুখ খোলার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই।
প্রায় ১৫০ কিলোমিটার রাস্তা পার করে যখন বেতলায় পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে- তবে জঙ্গলের ভাষায় নিশুতি রাত।আগেই বলেছি তখন ইন্টারনেট পরিষেবার এতো রমরমা নেই- আর বেতলায় দূরভাষও বিরল।কিন্তু ভগবান বোধহয় অসহায়দের উপর সদয় হন একটু বেশি করেই- স্থানীয় একজন একটা ছোট্ট হোটেল দেখিয়ে দিল- “শায়েদ খালি হায়”- এই এক লাইনই তখন আমাদের আশার আলো।হোটেল মধুবন – আজও নামটা মনে আছে- চাবি হাতে একজন মধ্যবয়স্ক কোথা থেকে উদয় হলো কে জানে।”একহি রুম মিল সকতা হায় – চার আদমি শো সকতা হায়”- ধুৎ তেরি তোর চার আদমি, আমরা তখন মাটিতে শুতেও রাজি-শুধু একটা ছাত আর জন্তুজানোয়ারের উপদ্রব আটকানোর জন্য একটা শক্ত দরজা।দৈনিক ভাড়া ৩৫ টাকা, সেও তখন আমাদের কাছ অনেক – আমার অর্ধাঙ্গিনী সেই মধুবন এর চেহারা দেখলে- তার বারান্দার কাছেও বোধহয় যাবেনা।কিন্তু বিপদের কি শেষ আছে- ব্যাগপত্তর মেঝেতে রাখতে না রাখতেই দুমদাম বাজি পটকার আওয়াজ।সময়টা বোধহয় অক্টোবর এর শেষেই হবে, ভাবলাম আগাম দিওয়ালির কুচকাওয়াজ চলছে।ভুল ভাঙলো মানুষের চিৎকারে- “হাথি আয়া রে”- হলোটা কি, দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই আরেক বিপদ।পাশের ঘরে যে আরেক নবদম্পতি ছিলেন তারাও তড়িঘড়ি বাইরের দরজা খুলে- নাঃ ভদ্রমহিলা বেরোতে পারেননি। দরজার উচ্চতা সত্যিই ছোট- অন্ধকারে ঠাহর করতে না পেরে, জোর ধাক্কা- আর প্রপাত ধরণীতলে।অত রাতে কপালে রক্তপাত, যদিও যৎসামান্য- কিন্তু কিছু তো একটা করতে হয়।কারো কাছে কিছু কি আছে- কেন যে হ্যাঁ বলেছিলাম সেদিন, আজও সে ঘটনাটা বিড়ম্বনার কারণ হয়ে আছে আমার কাছে।ততদিনে শ্রাবন্তীর ট্যাগলাইন “ত্বক যদি ফেটে যায়, কেটে যায়- সারা গায়ে মেখে নিন” আমার জীবনের প্রাত্যহিকীতে স্থান করে নিয়েছে- একটা বোরোলিনে এর টিউব সঙ্গে ছিল।শুধু বার করে দেওয়া নয়, ওনার কপালে বোধহয় লাগিয়েও দিয়েছিলাম- সেই নিয়ে বন্ধুদের চোখা চোখা বিশেষণ আজও শুনতে হয় আমায়।যাই হোক, অনেক রাত হয়েছিল শুতে- কাল খুব ভোরে উঠতে হবে।
সকাল সকাল পৌঁছে গেছিলাম জোড়া দুর্গে।স্থানীয়রা একে মেদিনী রায়ের গড় বলে।চেরো বংশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা- যদিও সবাই বলে তেকোনা পাহাড়ের উপর নতুন দুর্গটা ওনার ছেলে প্রতাপ রায়ের তৈরী।পুরোনো দুর্গের ঢোকার মুখেই একটা সুড়ঙ্গ-বোধহয় পালাবার রাস্তা, বিপদের দামামা বাজলেই- রাজা যঃ পলায়তি সঃ জীবতি। দুর্গের মাঝখানে এক বিশাল কুয়োর কথা আজও মনে আছে- এতো গভীর থেকে জল তুলতো কিভাবে কে জানে।নতুন দুর্গে পৌঁছানোটা বেশ কষ্টকর- কিন্তু ঢোকার মুখের তোরণে তখনও দেবনাগরী লিপিতে লেখাগুলো একদম স্পষ্ট।জঙ্গলে ভরা দুর্গে বেশি কিছু দেখার সুযোগও ছিল না, আর সূর্যিমামা ঠারে ঠারে জানান দিচ্ছিলো যে তার তেজ সে বাড়িয়েই যাবে। দুপুরে হোটেলে ফিরে পেলাম চাউল আর সবজি- ভাববেন না সবজি তে সবুজ এর লেশমাত্র ছিল- শুধু খোসা সুদ্ধু আলুর তরকারি- সেই তখন অমৃত।কারণ তখন উত্তেজনা- নিশি অভিযানের- সন্ধ্যেবেলা আমরা ঢুকবো অন্ধকারের ভিতর- জঙ্গল তখন আমায় টানছে- চাঁদ তুমি কখন উঠবে?
সবুজের প্রতি আমার এই আকর্ষণ বা মোহ যাই বলুন- বোধহয় আমার জঙ্গলপ্রেমের উৎস।বুদ্ধদেব গুহর একনিষ্ঠ পাঠক আমি- মাধুকরী, কোয়েলের কাছে, সবিনয়ে নিবেদন আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে।স্বপ্নে কতদিন যে পৃথুর মতো গভীর জঙ্গলে জীপ্ নিয়ে অচেনা গহন পথে ছুটে বেড়িয়েছি- রোমান্টিসিজম এর অলীক কল্পনা আর কি।দুপুরের একটা ছোট্ট ভাতঘুমের পর বেলা পড়তেই বিকেল বিকেল চারপাশটা একটু ঘোরার নেশায় হাঁটা দিয়েছিলাম।পঞ্চায়েত ক্যান্টিনটা সামনে পড়তেই- কিসের আশায় ভিতরে ঢুকেছিলাম এখন মনে নেই।তবে লাভ যে হলো সেটা বলাই বাহুল্য- রাতের দানাপানির ব্যবস্থা এরাই করে দিলো।হাতে গড়া রুটি, দেশি মুরগি আর কাঁচা পেয়াঁজ- জঙ্গলের নিশিভোজন- রাতে যে জমবে তাতে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।একটু এগোতেই- চোখে ভুল দেখছি না তো- এটা গাছ না বাড়ি ? নাঃ, গাছের উপর বাড়ি- জীবনের প্রথম দেখা এবং পড়া অরণ্যদেবের সব তাহলে সত্যি- এরপর হয়তো খুলিগুহা !! ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই এক নিভৃত আসরের দরজা খুলে গেলো।সুন্দর সাজানো গোছানো- কি নেই বাড়িতে- আহা, একদিন যদি এখানে থাকা যেত- রেস্ত যে বাদ সাধে।সদ্যযুবা আমি, তখনই ভেবে রেখেছিলাম পূর্ণিমার রাতে ভবিষ্যতের সে যদি মধুচন্দ্রিমায় এখানেই আমায় “চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে” শোনায়- হায়, স্বপ্ন কি বাস্তব হয়।ভবিষ্যতে এসে বুঝেছিলাম আমার অর্ধাঙ্গিনী যতই রোমান্টিসিজমের বুলি আওড়াক না কেন- এতো সস্তার মধুচন্দ্রিমায় কিছুতেই রাজি হবে না- তাই স্বপ্ন রইলো অধরা।
সূর্য ডুবে গেছে, চাঁদ উঁকি দিচ্ছে আকাশে- আর আমরাও প্রস্তুতি নিচ্ছি জীবনের প্রথম অরণ্যসফরের।গাঢ় পোশাক পড়া যাবে না, টর্চ্লাইট্ যেন সঙ্গে থাকে- বেতালের ফিসফিস কুঞ্জের মতো কথার আদানপ্রদান হবে- আরও কত আলোচনা- সব কি আর মনে থাকে।সন্ধ্যে তখন সাতটার আশেপাশে- জলপাই সবুজ জীপটা সামনে এসে দাঁড়াতেই- শরীর আর মনে একসাথে এক অজানা আনন্দ আর শঙ্কা- জীপ্ এর পিছনে উঠে তো বসলাম- বা দাঁড়িয়েই রইলাম বলতে পারেন- বন্যপ্রাণী একটাও আমার চোখের দৃষ্টি হারিয়ে লুকিয়ে যেতে পারবে না।জীপ্ এর সামনে ড্রাইভার আর ফরেস্ট গাইড, পিছনে আমরা- জীপ্ পাথুরে মাটির রাস্তা ধরে জঙ্গলের গেটে পৌঁছালো- কাগজপত্র দেখার পর, শুরু হলো নেশাতুর আমার জঙ্গলসুন্দরীর সাথে জীবনের প্রথম দেখা।কিন্তু একী দৃশ্য খুলছে আমার চোখের সামনে- গহন জঙ্গলের অন্ধকার কোথায় ? চারদিকে ছোট ছোট সবুজ টুনিবাল্ব জ্বলছে কেন- দ্বীপাবলি কি জঙ্গলেও লাগলো নাকি ? ছোটবেলা থেকে কাঁচের বোয়মে জোনাকি ধরার দিনগুলো যে এভাবে ফেরৎ আসবে কখনো ভাবিনি আমি।সবুজ আলো জ্বলছে নিভছে, মায়াবী সেই সন্ধ্যে- থুড়ি, জঙ্গলের রাত- আজ বন্যপ্রাণীদের আমার দৃষ্টি থেকে রেহাই নেই।যত ভিতরে ঢুকছি আওয়াজটা ততই বাড়ছে- কর্কশ আওয়াজটা এতো জোরদার কেন ? ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক এতো অদ্ভুত- কি রি রি থেকে ক্যারাও ক্যারাও হয়ে জঙ্গলে ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।যদিও বর্ণনাটা একটু ক্লিশে হয়ে গেলো, তবুও জঙ্গলের মৃদুমন্দ আলো আর হয়তো বা কিছুটা শ্রুতিকটুতা ধরে রেখে এই ছোট্ট প্রাণীগুলো রহস্যের জাল বিস্তার করেছে অনেকটাই বেশি করে।
ওমা, হঠাৎ কি হলো- কিছুটা যাওয়ার পর জীপটা দাঁড়িয়ে পড়লো কেন ? ফরেস্টগার্ডের ইশারা আর জীপ্ এর হেডলাইটে যা দেখলাম- প্রথম দর্শনেই জঙ্গলের নেশা কাটানোর পক্ষে তা যথেষ্ট।একটা আধটা নয়,একপাল হাতি, রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।গার্ডের বর্ণনায়, এটাই সেই হাতির পাল যারা কাল রাতে লোকালয়ে ঢুকেছিলো- পটকার আওয়াজে নিজের ডেরায় কিছুটা হলেও ফিরেছে।উৎসুক আমি- বুদ্ধদেব গুহ পড়ে নিজেকে জঙ্গলের বিশারদ বলে ভাবতে শুরু করে দিয়েছি- জিজ্ঞেস করলাম- ক্ষুধার্ত হাতি নাকি ভয়ঙ্কর হয় আর খেদা পেলে নাকি প্রতিআক্রমণ করে।গার্ড বোধহয় এই অর্বাচীনের ঔৎসুক্যে আর বক্তৃতায় একটু বিরক্ত- সে তখন সম্ভাব্য বিপদের আঁচ করতে পারছে। জীপগাড়িতে এতো আলো লাগানো যায় জানা ছিল না আমার- ব্যাটারির এতো ক্ষমতা ? সমস্ত আলোর ছটা চোখে লাগার জন্য- নাকি পুরো একসিলেটরের চাপে জীপ্ এর অসহ্য গর্জন কানে নেওয়ার বিড়ম্বনা থেকে বাঁচার আশায়- তারা সরলেন, আমরা এগোলাম।জীপ্ ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছে, দুপাশে শাল আর বাঁশগাছের জঙ্গল- মাঝেমাঝে কিছু মহুয়া গাছ- অদ্ভুত তার ফল।জীবনে এর পরেও বহু জঙ্গলে গিয়েছি- কিন্তু সেইসময়ের পালামৌ এর জঙ্গলের যে ঘনত্ব ছিল, তা কোথাও খুঁজে পাইনি।অস্ট্রেলিয়ান ঘাসের মতো লম্বা লম্বা শরবন্- পরে জেনেছিলাম ওটা খয়ের ঘাস, পালামৌ জঙ্গলের বৈশিষ্ট্য- আর জন্তুজানোয়ারদের আড়ালের হাতিয়ার।বেতলার হরিণ নাকি জীপ্ এর সাথে দৌড়ায়- এটা গল্প নয় সত্যি- সেদিনই দেখলাম।একটা বাঁক ঘুরতেই দেখেছিলাম তাকে, নিশ্চিন্তে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে- কালো খোদাই করা চেহারা, লাল চোখের শাসানি- জঙ্গলের বাইসন, বাঘের থেকেও ভয়ঙ্কর।বাঘের কথায় মনে পড়ে গেলো- বই পড়া বিদ্যে তো- পালামৌ এর জঙ্গলে তখনই নাকি গোটা পঁচিশেক বাঘ আছে।বিশ্বাস করুন, বনবিবির যে বাহনকে দেখার আশায় মূলতঃ জঙ্গলে ঢোকা- না তার গন্ধ পেলাম, না দেখলাম পায়ের ছাপ- দেখা তো দূর অস্ত।ছ ছটা দুরন্তযৌবন বাংলার বাঘ যে গাড়িতে সওয়ার- তার সামনে জঙ্গলের রাজার ও দেখা দেওয়াটা বোধহয় সেদিন সাহসে কুলায়নি।ফেরৎ আসার সময় একটা ছোট্ট ঘটনা না বললেই নয়।ড্রাইভার এক জায়গায় হঠাৎ ব্রেক কষলো-“ডাহিনা তরফ দেখিয়ে বাচ্চা হাতি”- আর সাথে সাথে ধুপ আওয়াজ।জঙ্গলের সবচেয়ে বিপদজনক এবং অন্যায় কাজটা করে বসলো আমার এক বন্ধু। জীপ্ এর পিছন থেকে ক্যামেরা শুদ্ধু লাফিয়ে পড়লো মাটির শুঁড়িপথে- কাছ থেকে ছবি তুলবে বাচ্চা হাতির।ক্যামেরার কথায় পরে আসবো, বিশ্বাস করুন, সিনেমায় দৃশ্যের ফাস্ট রিভার্স বা রোল ব্যাক দেখেছি- কিন্তু তখন বাস্তবে সেটাই দেখলাম। যে তৎপরতায় বন্ধুটি লাফিয়েছিলো, তার দ্বিগুন ক্ষিপ্রতায় স্প্রিং এর মতো লাফিয়ে জীপে উঠে এলো সে।জিজ্ঞেস করলাম, ছবি তুললি না- সে আঙুল তুলে দেখালো- জীবনে প্রথম গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা দাঁতাল দেখলাম- সন্তানস্নেহে মানুষের মতোই সে সযত্ন।ফিরতে ফিরতে বেশ রাত- পঞ্চায়েত ক্যান্টিনের সেই খাওয়া আজও ভুলিনি।রাতে বিচ্ছানায় শুতেই- ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু-কিন্তু ঘুম যে কিছুতেই আসছে না- কাল সকালে উঠেই যে যাবো আমার প্রেয়সীর কাছে- সুন্দরী কোয়েল যে আমার অপেক্ষায়- আমি আসছি- তুমি সাজো কোয়েল।
পালামৌ এর জঙ্গলে সকালে ঘুম ভাঙাটা একদম অন্যরকম- শহুরে আমি-এতো পাখির ভিন্ন ভিন্ন ডাক শুনিনি কোনোদিন- সালিম আলী পড়া থাকলে হয়তো চিনতেও পারতাম কয়েকটাকে।নাঃ- আর দেরি করা যাবে না, রোদ বেশি বাড়লে তার সাজ যে নষ্ট হয়ে যাবে- মোহময়ী কোয়েল যে বসে আছে আমার কাছে ধরা দেবার অপেক্ষায়।লড়ঝড়ে স্থানীয় বাস নামিয়ে দিয়ে গেলো প্রায় সাত আট কিলোমিটার দূরে।একটা রেলের ব্রিজ ছাড়া সেই মুহূর্তে আর চোখে কিছুই পড়ছিলো না।ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বেরোলো, ছবি উঠতে থাকলো- ক্লিক ক্লিক আওয়াজটা মনে পড়তেই, ক্যামেরার দু চার লাইন বিবরণ না লিখে থাকতে পারলাম না। তখন বোধহয় আগফা কোম্পানির একটা ক্যামেরা ছিল আমার- তাই তখন অনেকের কাছে অধরা।সেই ক্যামেরার মাথায় আলাদা করে ফ্ল্যাশ লাগাতে হতো- বেড়াতে যাওয়ার আগে প্রথম কাজ ছিল তাতে ফিল্মের রোল ভরা।ফুজি আর কোডাক এই দুটো নামই মনে আছে- ৩২ বা ৩৬টা নেগেটিভ এর এক একটা রোল- তা ক্যামেরায় ভরার কায়দা এবং কষ্ট দুটোই ছিল।সাদা কালোর সময় তখন, ফেরৎ এসে ফটোর দোকানে ছুটতে হতো ছবি প্রিন্ট করতে। বিশ্বাস করুন, আজকে আমার দামি ডি এস এল আর এ টেলি লেন্স লাগিয়ে ছবি তুলে আর ল্যাপটপ এ দেখে সেই আনন্দ বা উত্তেজনা কোনোটাই পাই না।
রাস্তা থেকে হেঁটে একটু এগোতেই প্রকৃতি তার অপিরিসীম সৌন্দর্য খুলে ধরলো আমার সামনে।জায়গাটার নাম কেচকি- অনেকেই হয়তো দেখেছেন তাকে- তবে আমি তাকে দেখেছি সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে, ভাঁজে ভাঁজে- পরতে পরতে অপার্থিব আকর্ষণ ছড়িয়ে সুন্দরী সেজে বসে থাকতে।বিভঙ্গি কোয়েল আর উচ্ছসিত ঔরঙ্গা এসে মিশেছে কেচকিতে।দুজনেরই গভীরতা হয়তো কম- কিন্তু গভীরতা কি কখনো সৌন্দর্যের মাপকাঠি হয়? নদীর বুক থেকে তোলা রেলের ব্রিজ এর ছবি আজও আমার কাছে আছে-অনেকক্ষন বসে ছিলাম- একটা রেলগাড়ি যদি যায়।ব্রিজ এর উপর মালগাড়ি দেখেছি- রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে উপর থেকে সঙ্গমরত কোয়েল আর ঔরঙ্গা কে দেখেছি- দুধারে সবুজ প্রকৃতি আর আমরা, নীরবতায় এই মিলন- সাক্ষী শুধু আমরা কজন।হাস্যকর একটা ছেলেমানুষি মনে পরে গেলো- কোয়েলের কাছে এলাম, তাকে ছুঁয়ে দেখবো না- এই ইচ্ছেকে মর্যাদা দিতে গিয়ে নেমে পড়েছিলাম কোয়েলের বুকে।সামান্য দুহাত গভীর জলে আমার সাঁতার কাটার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার ছবিও আছে আমার কাছে- আজও আমার বন্ধুমহলে রসিকতা চলে তা নিয়ে।ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো- নাঃ আজ আর বেশি রাত করা যাবে না, ব্যাগপত্তর গোছাতে হবে।মধুবন- তোমার অবয়ব যতই মলিন হোক, তোমার স্মৃতি নিয়ে কাল বিদায় নেবো আমি- তুমি আমায় এই কদিনে দিয়েছো আশ্রয়- সুযোগ করে দিয়েছো প্রকৃতিকে আলিঙ্গন করার- জঙ্গলকে দুচোখ ভোরে দেখার- আর সবার শেষে সুন্দরী কোয়েলের বুকে অবগাহনের। বিদায় পালামৌ, কাল যাবো ছোটোনাগপুরের রানীর কাছে- সে যে স্বপ্নসুন্দরী।
More From Author
- None Found