ইনডিপেনডেন্স ডে-SAMADRITA MONDAL-2nd-Bangla Story

সকাল ৮টা, পাড়ার মাইকের গানে ঘুম ভাঙলো মৃণালিনীর।
“হায় ওয়াতান , ওয়াতান মেরে অবাধ রহে তু।”
আজ ইনডিপেনডেন্স ডে, অফিস ছুটি তাই একটু লেট ঘুম থেকে উঠলো মৃণালিনী। ঘুম ভাঙতেই মনটা বেশ খুশিতে ভরে উঠলো। একে ছুটির আমেজ, তারপর দীর্ঘ্য অপেক্ষার পর আজ দেখা হবে আসালাউয়েরের সাথে। প্রেম শুরু হতে না হতেই লকডাউন, কাজেই পরিস্থিতি একটু থিতু হওয়াতে আজকের দিনটাকেই বেছে নিলো মিট করার জন্যে। বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি সব কাজ সেরে নিতে লাগলো মৃণালিনী। আজকের জন্যেই তো সারপ্রাইজটা রেখে দিয়েছে এতদিন ধরে।
বছর ৩৩ এর মৃণালিনী একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ডাটা এনালিস্ট। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াই সে একাই। কত দুর্গম জায়গায় ট্রেকিঙ করে এসে অবাক করে দিয়েছে দাদা বৌদিকে। শরীর এবং মনে সে বয়েসের কোনো ছাপই পড়তে দেয়নি আজ অবধি। মৃণালিনীদের 3BHK ফ্ল্যাটের ফ্রিজটাই তার ঘুরে বেড়ানোর প্রতীক। যে দেশেই যাক, সেখানকার ম্যাগনেট কিনে এনে চিপকে দেয় এই ফ্রিজের ওপর। মৃণালিনীর এই উদ্দামতা তাকে পপুলার করেছে তার কর্মস্থলেও। বলাই বাহুল্য, সে পেয়েগেছে বছরের বেস্ট পারফরমারের খেতাব।তার দশ বছরের পরিশ্রমের ফল হিসাবে অফিস থেকে পেয়েছে একটি দোতলা কোয়ার্টার। এই কোয়ার্টারেরকে ঘিরেই যত পরিকল্পনা মৃণালিনীর, তার পুরোটাই আজ গচ্ছিত আছে, সারপ্রাইজ।
আসলাউর এবং মৃণালিনীর আলাপটা কিন্তু কর্মস্থল, ট্রেকিঙ অথবা ফেসবুকে হয়নি। সেদিন খুব বেশ বৃষ্টি হচ্ছিলো। মৃণালিনী ড্রাইভ করে সবে গড়িয়াহাটের মোর ক্রস করতে যাবে, এমন সময় চোখে পড়লো রাস্তায় জমায়েত। একটু খটকা লাগলো মৃণালিনীর। গাড়িটাকে সাইড পার্ক করে রেখেই ছুটে গেলো সেদিকে। গেয়ে দেখে বছর ৩০ এর একজন বইকে স্কিড্ করে এক্সিডেন্ট করেছে সাথে প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। কোনো কিছু আর না ভেবেই মৃণালিনী তুলে নিলো তাকে গাড়িতে, সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল।
বছরখানেক আগের ঘটনা আজও স্মৃতিতে ছবির মতো উজ্জ্বল। মৃণালিনী অপেক্ষা করছে অপারেশন থিয়েটারেরের বাইরে। রিলেশনশিপ উইথ পেশেন্ট কি লিখবে ভেবে না পেয়ে লিখে দিলো ‘ফ্রেন্ড’। ছেলেটাকে আগে বাঁচানো দরকার। ততক্ষনে পুলিশ হাসপাতাল এসে ইনভেস্টিগেশন শুরুও করে দিয়েছে। ডাক্তার এসে জানালেন প্রচুর ব্লিডিং হওয়ার ফলে পেশেন্টএর অবস্থা শোচনীয় তক্ষনি ব্লাড জোগাড় করতে লাগবে। হাতে এতো কম সময় যে ভাবারও অবকাশ নেই। মৃণালিনী ঠিক করলো, ও নিজেই ব্লাড দেবে। কাকতালীয় ভাবে ব্লাড গ্রুপ মিলেও গেলো, ধীরে ধীরে সেরে উঠলো আসলাউর।
এই ছিল আসালাউরের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। আসলাউর ডিসচার্জ হওয়ার পর মৃণালিনী বেশ কবার তার বাড়িতেও গেছে তার খবর নিতে। বেশ লাগলো আসালাউরের পরিবারের সাথে আলাপ করে। মৃণালিনী অনেক কিছু জানতে পারলো আসালাউয়েরের ব্যাপারে। পেশায় সে একজন স্কুল শিক্ষক। আসলাউর ও মৃণালিনী এখন প্রায়ই ফোনে কথা বলে বা হোয়াটসআপ চ্যাট করে যার বেশিরভাগটাই অপ্রাসঙ্গিক। ধর্ম কোনোই ব্যবধান রইলো না প্রেমের মাঝে।
এরমভাবেই চ্যাটিং আর দেখা সাক্ষাৎ চলতে থাকে। তাদের ভিন্ন ধর্ম যা বাধা দিতে পারেনি প্রেমে, তা দিলো লকডাউন। অগত্যা এখন ফোনে কথা বলাটাই ভরসা। এর মধ্যে দুজনে ঠিক করে যে এবার তাদের বিয়ের কথা ভাবা উচিত। মৃণালিনীর বাবা মা নেই, আছে দাদা বৌদি, মৃণালিনী দুজনেরই খুব আদরের। প্রায় সব কথাই শেয়ার করে তাদের সাথে। যদিও এখনো পর্যন্ত আসালাউরের দিক থেকে কোনো কিছু পরিষ্কার জানা যায়নি, আশা করা যায় আজ দুপুরেই আসলাউর এসে তাকে সুখবরটা দেবে। দুজনের মধ্যে সেইরকমই কথা হয়েছে। সত্যি, কতদিনের ইচ্ছে মৃণালিনীর এরম একটা জয়েন্ট ফ্যামিলি তে সে বিয়ে করবে, সে হোক না যতই ধর্ম আলাদা।
মৃণালিনী আজ পরেছে একটা হলুদ শাড়ী, সাথে লাল ব্লাউজ। প্রতিদিন সুটেড বুটেড সাজতে কি আর ভালোলাগে? আজ অবকাশ পেয়েছে ছুটির দিনে একটু অন্য রকম সাজবার। আজ আসলাউরকে সারপ্রাইজটা দেবে কোয়ার্টারটার বেপারে। এই কোয়ার্টার এই গড়ে তুলবে তাদের নতুন সংসার।নিচের তলায় থাকবে লাইব্রেরি, টিউশনি আর আসালাউরের পড়াশোনার জায়গা। ওপরের তলায় থাকবে তারা দুজনে। উউফ! কতক্ষনে যে বলবে আসলাউরকে!
আসলাউর: হ্যালো! কোথায় তুমি? আমি ক্যাফেটেরিয়ার পার্কিংএ গাড়ি লাগাচ্ছি
মৃণালিনী: এইতো গেটে থার্মাল চেকিং চলছে
আসলাউর: ওকে। ভিতরে গেয়ে অর্ডার টা দাও আমি আসছি
আসলাউর: তাহলে? ম্যাডাম দেখা দিলেন তাহলে?
মৃণালিনী: হে হে। আমাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্যেই তো সবকিছু
এই ক্যাফেটেরিয়া টা দ্যাখো কি ভালো ভাবে মনিটর করছে সব
আসলাউর: হ্যা…
মৃণালিনী আজ নিজে হাতে আসলাউরের প্রিয় খাবার বানিয়ে প্যাক করে এনেছিল, মটন রোগান জোশ। সেটা টেবিলে রেখে জিজ্ঞাস করলো। বাড়ির সকলে কেমন আছে? আসলাউর হয়তো ইঙ্গিতটা বুজতে পেরে একটু চুপ থাকলো। তারপর বললো
আসলাউর: মৃণালিনী তোমাকে কটা কথা বলার ছিল
মৃণালিনী: কি বলো
আসলাউর: জানোই তো আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি, সবাই কে নিয়ে চলতে হয়।
মৃণালিনী: হা জয়েন্ট ফ্যামিলি তো আমার পছন্দের
আসলাউর: বাড়ি থেকে ৩টি শর্ত দিয়েছে তোমাকে। মানলে তবেই ওঁরা রাজি হবে।
মৃণালিনী: কি শর্ত?
আসলাউর: বিয়ে করে আমাদের বাড়িতে এলে তোমার মৃণালিনী নাম টা আর রাখা যাবেনা। বোঝইতো আমাদের তো কিছু নিয়ম কানন থাকে। আর পরের টা হলো তোমাকে আমাদের ধর্মই পালন করতে হবে যেমন রোজার মাসে রোজা রাখা, ঈদ এ মেহেন্দি পড়া এসব আর কি।
মৃণালিনী: তৃতীয় শর্ত?
আসলাউর: বাড়ির লোক চায়না তুমি আর অফিসে যাও।
মৃণালিনী কি বলবে ভেবে পেলোনা। আসলুর এর থেকে ভাবার মতো সময় চাইবে কি? আসলেউরদের যা অবস্থা, তাতে মৃণালিনী চাকরি না করলে তার কোনো অসুবিধেই হবেনা। আর ধর্ম? সব ধর্মই সমান মেনে এসেছে সে এতো বছর। কিন্তু তার নামের পরিবর্তনটা? বাবা মা চলে যাওয়ার পর শুধু নাম টাই তো আছে তাঁদের দেয়া জিনিস; যেটাকে সে বাঁচিয়ে রেখেছে এতদিন সব স্ট্রাগগলের ফল হিসেবে।
মৃণালিনীর ভিতরটা যেন ভারী হয়ে আসছে। একটু কাঁদবে কি সে? উঠে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে।
আসলাউর: কি হলো? ওয়াশরুম যাবে? শরীর খারাপ লাগছে?
মৃণালিনী মাস্ক পড়ছে। চশমার আড়ালে জমছে চোখের জল। ব্যাগ টা নিয়ে নিলো কাঁধে,
এগিয়া যাচ্ছে ক্যাফেটেরিয়ার এক্সিট গেটের দিকে
আসলাউর: মৃণালিনী… মৃণালিনী…
মৃণালিনী আজ আর পিছনে ফিরবেনা
টেবিলের ওপর প্যাক করে রাখা আছে রোগান জোশ
সারপ্রাইজটা আর দেওয়া হবেনা কোনোদিন
বাস রাস্তা ক্রস করতে করতে শুনতে পেলো মাইকে বাজছে
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা চলো রে ”
More From Author
- 15 ই আগস্ট-SAIKAT BISWAS-3rd-Bangla Story
- স্বাধীনতার মানে-Abhinandan Barua-1st-Bangla Story
- A DIFFERENT STORY OF AZADI-MEHULI DAS-3rd-English Story