মহামারী করোনা ও অপরাজেয় মানবতা

বলতে গেলে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ হলো-করোনাভাইরাস। তাবত ক্ষমতাধর রাষ্ট্র পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থেই কোণঠাসা এই ভাইরাসের প্রতাপে।
গোটা বিশ্বের আতংক হিসেবে আবির্ভূত হওয়া করোনাভাইরাস ২০১৯ সালের গোড়ার দিকে প্রথম দেখা যায় চীনের উহান প্রদেশে।
গবেষকরা বলছেন, চীনের হর্সশু নামের একপ্রকার বাদুড়ের সঙ্গে এই ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে।
করোনাভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন ভাষার “Corona” থেকে নেওয়া হয়েছে। ” Corona” শব্দের অর্থ “মুকুট”। কারণ দ্বিমাত্রিক সঞ্চালন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটির আবরণ থেকে গদা-আকৃতির প্রোটিনের কাঁটাগুলোর কারণে ভাইরাসটিকে অনেকটাই মুকুট বা সৌর করোনার মত দেখায়। এই ভাইরাসটির উপরিভাগ প্রোটিন সমৃদ্ধ থাকে যা ভাইরাল স্পাইক পেপলোমার দ্বারা এর অঙ্গসংস্থান গঠন করে থাকে। এ প্রোটিন সংক্রমিত হওয়া টিস্যু বিনষ্ট করে দেয়। ভাইরাসটি ডাইমরফিজম রূপ প্রকাশ করে।
করোনাভাইরাস রাইবোভিরিয়া পর্বের নিদুভাইরাস বর্গের করোনাভিরিডি গোত্রের অর্থোকরোনাভিরিন্যা উপ-গোত্রের সদস্য। তারা পজিটিভ সেন্স একক সূত্রবিশিষ্ট আবরণীবদ্ধ বা এনভেলপড ভাইরাস। তাদের নিউক্লিওক্যাপসিড সর্পিলাকৃতির। এর জিনোমের আকার সাধারণত ২৭ থেকে ৩৪ কিলো বেস-পেয়ার (kilo base-pair) এর মধ্যে হয়ে থাকে যা এ ধরনের আরএনএ ভাইরাসের মধ্যে সর্ববৃহৎ।
করোনাভাইরাস বলতে মূলত ভাইরাসের একটি গোত্রকে বোঝায়। যেগুলো স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদেরকে আক্রান্ত করে। তবে বর্তমানে আক্রমণকারী প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটিকে Covid-19 নামে অভিহিত করা হয়। ধারনা করা হয়, প্রাণীর দেহ থেকে এই ভাইরাস প্রথম মানবদেহে প্রবেশ করে।
আর মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস শ্বাসনালীর
সংক্রমণ করে। এই ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ প্রথম দিকে মৃদু হতে পারে। রেসপিরেটরি লক্ষণ ছাড়াও জ্বর, কাশি, শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত প্রধান লক্ষণ। এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত শুষ্ক কাশি ও জ্বরের মাধ্যমেই শুরু হয় উপসর্গ। তারপর শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। মাঝেমধ্যে এই লক্ষণের তারতম্য দেখা যায়।
সাধারণত রোগের উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে গড়ে পাঁচ দিন সময় নেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তবে কিছু কিছু গবেষকের মতে এর স্থায়িত্ব ২৪দিন পর্যন্ত থাকতে পারে।
বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের কোনো ধরণের অসুস্থতা রয়েছে যেমন : অ্যাজমা, ডায়বেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপইত্যাদি তাদের মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চিন থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই করে জানা যায় যে, এই রোগে নারীদের চেয়ে পুরুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা সামান্য বেশি।
অদৃশ্য এই ভাইরাস সারা পৃথিবীকে পরিণত করেছে বিভৎস এক মৃত্যপুরীতে। চারদিকে বিরাজ করছে কেবলই আতংক।
বিশ্বে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ যাবত মৃতের সংখ্যা ৫৬ লক্ষের বেশি। খোদ আমেরিকায় মৃতের সংখ্যা ছাড়াল ১ লক্ষ। বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের তালিকায় প্রতি ২৪ ঘণ্টায় গড়ে যুক্ত হচ্ছে ৬২ হাজার ২৪০ জন মানুষ। চিন, আমেরিকা, ইটালি, ফ্রান্সসহ উন্নত দেশগুলোতে দোর্দন্ডপ্রতাপে শাসন করে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া করোনায় প্রতিনিয়ত কোনঠাসা হচ্ছে বিশ্বসেরা দেশগুলো।
তবে একটি বিষয় খেয়াল করার মতো যে, এই দুর্যোগ সময়ে নতুন করে চাঙা হচ্ছে মানবতাবোধ। অসুস্থ ও অসহায় মানুষের কষ্টে কেঁদে ওঠছে সুস্থ ও সম্পদশালী মানুষের অন্তর। জাগিয়ে তুলছে তাদের মানবসত্তাকে।
এই সেদিনও বিশ্বমোড়লের আসনটি ধরে রাখতে মরিয়া ছিলো আমেরিকা। এর ওর পেছনে উঁকিঝুঁকি মেরে নিজের কল্পিত শত্রুদের খুঁজে বের করার মার্কিনীয় কসরতে অনেক উলুখাগড়া দেশকে খেতে হতে হয়েছে ভীমড়ি।
কত দিন আর হবে পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে যুদ্ধের দামামা এই বেজে উঠছিলো বলে।
ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অসংখ্য নিরীহ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে ছিলো তুলকালাম অবস্থা। আমার প্রাণের বাংলাদেশইবা বলি না কেনো? রাজনৈতিক টুকাটুকি লেগেই তো থাকতো রাজপথ কিংবা টকশোর মঞ্চজুড়ে। পাশের মিয়ানমারের রোহিঙ্গানিধন,
সিরিয়ায় তথাকথিত ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা, চিনের উইঘুরে সাম্প্রদায়িক নিধনযজ্ঞ, কাশ্মিরের অস্থিরতা শান্তিকামী মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রাখতো। টেলিভিশনের পর্দা আর ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার পাতা ছিলো যুদ্ধবাজদের দখলে। সাম্রাজ্যবাদীদের আস্ফালনে মানবতাবাদীরা ছিলো কোনঠাসা। কিন্তু আশার কথা- এই করোনা পরিস্থিতিতে দৃশ্যপট পুরোটাই বদলে গেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্যামেরার ফ্ল্যাশলাইট মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে আগের মোড়ল আর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্যামেরার ফ্ল্যাশলাইট দৃষ্টি দিতে শুরু করে দিয়েছে সংক্রমণ রোধে কর্মহীনদের খাদ্য সহায়তা দানকারী শেরপুরের ভিক্ষুক নাজিম কিংবা চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল বাগানবাজারের ক্ষুদ্র তরকারি ব্যবসায়ী তাজুল ইসলামের উপর। মিডিয়ার সংবাদ মূল্যের শর্ত ‘প্রমিনেন্ট’ এর যেনো ধরণই বদলে গেছে।
এতো কিছুর মূলে যে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ (করোনা) এর প্রভাব, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বলতে গেলে ‘করোনা ভাইরাস’ বর্তমান বিশ্বে এই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রভাবশালী শব্দ । তাবত ক্ষমতাধর রাষ্ট্র পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থেই কোণঠাসা এই ভাইরাসের প্রতাপে। গোটা বিশ্বের আতংক হিসেবে আবির্ভূত হওয়া করোনাভাইরাস গত বছরের গোড়ার দিকে চিনের উহান প্রদেশে দেখা দিলেও বর্তমানে এর একচ্ছত্র আধিপত্য বিশ্বজুড়ে।
করোনা সারা পৃথিবীর স্বাস্থ্যখাতকে করে দিয়েছে একেবারে লণ্ডভণ্ড। অর্থনীতিতে করে দিয়েছে তছনছ। বলতে গেলে হাজার বছরের তিলে তিলে গড়ে তোলা বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, প্রযুক্তির তাবত অর্জনকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। করোনা মোকাবেলায় সভ্য দেশের বাঘা-বাঘা বিজ্ঞানীদের সামনে এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
আর তাতেই করোনার বাজিমাৎ। বিশ্বের সমস্ত দাম্ভিকতাকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে বিশ্ববাসীকে ভাবাতে শুরু করে দিয়েছে নতুন করে। করোনানামীয় অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে বিশ্বমোড়লদের আজ করুণ আত্মসমর্পণ।
ক্ষমতার আধিপত্য, অর্থের অহমিকার পরাজয়ে নতুন করে মানবিকতার বিজয়গাথা রচিত হচ্ছে। প্রমাণিত হয়েছে বিত্তের চেয়ে চিত্ত বড়।
আর সে কারণেই সংক্রমণ রোধে কর্মহীনদের খাদ্য সহায়তা গঠিত ইউএনও’র ত্রাণ তহবিলে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারেন ৮০ বছর বয়সী ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিন আর আরেক হতদরিদ্র তাজুল ইসলাম। নাজিম ভিক্ষা করে সংসার চালান। নিজের বসতঘর মেরামত করার জন্য দুই বছরে ভিক্ষা করে জমিয়েছেন ১০ হাজার টাকা। কিন্তু জমানো টাকা দিয়ে ঘর মেরামত না করে কর্মহীনদের খাদ্য সহায়তার জন্য খোলা তহবিলে দান করে মানবিক মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। আর তাজুল ইসলাম নিজের ঘরে সোমন্ত চার কন্যাসন্তান থাকার পরও নিজের একমাত্র অবলম্বন গাভীটিকে বিক্রি করে তার মতোই অন্য কিছু দরিদ্র মানুষের হাতে সাহায্য তুলে দিতে পেরেছেন। কিংবা রাউজানের অধ্যক্ষ শিমুল বড়ুয়া স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ধর্মীয় মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান না করে সেই টাকা দিয়ে নিজ ধর্মের অনুসারী বাদেও রমজানে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মাঝে ঈদ উপহার সামগ্রী বিতরণ করেছেন। দেশের বড় বড় শিল্পপতি, বিত্তবান ধনাঢ্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু পেশাজীবী, সামাজিক সংগঠন এমনকি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন কেউ বাদ যাচ্ছে না দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো থেকে। রাষ্ট্রের সমস্ত মনোযোগ এখন জনগণের কল্যাণ চিন্তায়।
মোড়ল রাষ্ট্রগুলোও অস্ত্র উৎপাদনের পরিবর্তে মনোযোগ দিয়েছে টিকা ও ওষুধ উদ্ভাবনে।
বিশ্বব্যাপী মুখ তুবড়ে পড়া অর্থনৈতিক অবস্থার পরও সবার নজর এখন মানুষের কল্যাণে। ট্রাকভর্তি ত্রাণের প্যাকেট পৌঁছে যাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। নামদাম গোপন রেখেও দান করছেন অনেকে। চারদিকে এমন অভাবনীয় মানবিক উদ্যোগ করোনায় বিপর্যস্ত সময়ে মনের ভালোলাগায় একটুখানি দোলা দিয়ে যায়। করোনাকালের পরে একটি মানবিক বিশ্ব গড়ে উঠবে বলে আশা জাগায়। করোনাপরবর্তী সময়েও যেনো মানবতা বেঁচে থাকে- আমাদের রোজকার প্রার্থনায় এটাও যুক্ত হোক। এই প্রার্থনার পাশাপাশি আমরা আরও একটি শুভ কামনা করতে চাই, তা হলো –
মানবদেহে সৃষ্ট করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়ানোর মত কোনো টিকা বা অ্যান্টিভাইরাল ও ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। আক্রান্ত ব্যক্তি যেন শ্বাস প্রশ্বাসে সহায়তা পায় এবং তার দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যেন ভাইরাসের মোকাবেলা করতে পারে তা নিশ্চিত করাই বর্তমানে চিকিৎসকদের মূল উদ্দেশ্য। তবে আশা জাগানিয়া খবর হতে পারে যে পৃথিবীর অনেকগুলো উন্নত দেশের সাথে বাংলাদেশও এই এই প্রাণঘাতী ভাইরাস নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে, চেষ্টা করে যাচ্ছে এই রোগ সনাক্তকরণ ও প্রতিষেধক আবিষ্কারেরও। তবে কবে নাগাদ আশার আলো জ্বলে উঠে তার দিকে দৃষ্টি এখন কোটি কোটি জোড়া চোখের। আমাদের শুভ কামনা- একদিন আলো জ্বলবেই।
More From Author
- None Found