রজনী, হিমু ও কিছু কাঠগোলাপ

এই লেখাটা লিখার চিন্তা মাথায় আসে মূলত এক ক্লাসমেটের কোয়ারেন্টাইনে হিমুর দিনকাল নিয়ে লেখা দেখে লোভে পড়ে।লেখার সময় নিজেকে অতিরিক্ত সাহসী মনে হয়েছে, কেননা এরকম লেখায় আমার হাতের আনাড়িপনা আর চরিত্রের খ্যাতির মধ্যেকার ফারাক প্রায় বৃহস্পতি থেকে নেপচুনের দূরত্বের সমতূল্য। সাহসের সাথে অনেক বড় একটা আশাও ছিল যে, নিশ্চয়ই আমার হিমুর জন্যে অপরিসীম ভালবাসা আর হুমায়ুন আহমেদ স্যারের জন্যে অজস্র শ্রদ্ধার ব্যাপারটাও কাউণ্টে আনা হবে। অতিরিক্ততার চূড়ান্ত: আশা করি ধ্রৃষ্টতা মার্জনীয়।
********
ঠান্ডা একঝলক বাতাসে ঘুমটা কেটে আসল।বাইরের বৃষ্টির শব্দে মনে হচ্ছে ঢাকা শহরের আকাশ আজ ভেঙে পড়বে। আচ্ছা এটাও কি কখনো সম্ভব আকাশ ভেঙে পড়া? কতবার এই উপমাগুলো শুনেছি, “আকাশ ভাঙা জোছনা”,” আকাশ ভাঙা বৃষ্টি”। আসলেই যদি হয় তাহলে কেমন হবে? পরে ভাবা যাবে, চিন্তা করে যেই না আবার আধা ঘুম আধা ঘোরের সেই বিভ্রান্ত মিশ্রণটায় ফেরত যাব ; এমন সময় কপালে টুপ করে গরম কি যেন পড়ল, খুব সম্ভবত পানির ফোঁটা। চোখ মেলে দেখি বাদল, আমার মাথাটা ওর কোলের উপর নিয়ে বসে আছে।
এই গাধা, এখানে কি করিস?
দাদা, তোমার এখন কেমন লাগছে?
খুব বিরক্ত লাগছে, এই আরামের আবহাওয়ায় মাথার কাছে বসে ডিস্টার্ব করছিস।ভাগ ইয়াহা সে!
আমার মুখে হিন্দি শুনে ফিক করে হেসে দিল। হাসির সময় চোখ ছোট হয়ে আসতেই এক ফোঁটা পানি ঝরে পড়ল।গাধাটা কি আসলেই কাঁদছিল?
এই গাধা, কাঁদিস কেন?
না তো, কোথায়?
শেষের কোথায় এর ওপর অযাচিত জোরটা শুনেই বোঝা গেল মিথ্যা বলছে। সাধে কি আর ওকে গাধা বলে ডাকি!
এত্ত বড় ধাড়ি ছেলে, এখনো মিথ্যা বলতে পারিস না, আবার বলতে যাস কেন?কাঁদছিস দেখি।
হু…
হু কি?
দাদা তোমার একটা ফোন এসেছিল।রুপা নামের একজন।
গাধাটা কথা ঘুরাতে চাচ্ছে।আহা বেচারা! এভাবে আক্রমণ করা আমার উচিত হয়নি।হাজার হলেও পুরুষ, কান্না আড়াল করার ব্যাপারটা অনেক পূর্বপুরুষ থেকে রক্তে বইছে।
রুপা কি বলল?
জিজ্ঞেস করলেন তুমি এখানে কি না। কেমন আছো এইসব।
তা কি বললি?
বললাম তোমার জ্বরের কথা, যে লকডাউনে তোমার খালি পায়ের হণ্টন বিলাসে বের হয়ে পুলিশের কাছে একদফা মার খেয়ে বাধিয়েছ।উনি শুনে কিছু বললেন না, অনেকক্ষণ পর জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে খুট করে ফোনটা রেখে দিলেন।
যাক।মেজ ফুপুর রাগ কমেছে?
মা ঠান্ডা হয়েছেন।কিন্তু বাবা বলেছেন আরেকবার বের হওয়ার চেষ্টা করলে দুই পায়ে দুইটা বুলেট ঢুকিয়ে দেবেন। স্ট্রেইট টু দ্য নি’জ।
বাদলের কপট গাম্ভীর্যে মনটা ভাল হয়ে গেল। চুপচাপ শুয়ে দুইজন মিলে বৃষ্টির আওয়াজে কান পেতে দিলাম। গলির ল্যাম্পপোস্টএর আবছা আলোয় ওকে কি সুন্দরই না লাগছে।আহা, এই ছেলেটা আমার জন্য এত মায়া জমিয়ে রাখে কেন?! জ্বরটাও নেমে এসেছে।
পুলিশের মার খেয়ে বাধানো জ্বর মনে হয় এতও কষ্টদায়ক না ;হয়ত ঝুম বৃষ্টি, মাথার কাছে বসে থাকা রূপবান তরুণের এক রাশ মায়া, আধা ঘুম আধা ঘোর এর মাঝে ভেসে থাকার অদ্ভুত অনুভূতি – এসব মিলিয়ে তেমন টের পাচ্ছি না।আসলেই, বেঁচে থাকাটা অসাধারণ রকমের সুন্দর, কত না আজব সব সময়ে আজব সব উপায়ে জীবন আমাদের এই কথাটা মনে করিয়ে দেয়!
আস্তে করে গেটটা লাগিয়ে ঠান্ডা পিচে পা পড়তেই মনটা ভরে উঠল। আহ! মুক্ত বাতাসে বুকের ভেতরটায় উথাল পাথাল হয়ে গেল। কত দিন পর যেন বন্ধুর সাথে দেখা, মায়া-মমতা-জমে থাকা অভিমান-একাকিত্বের পাহাড় নিয়ে জোর এক আলিঙনে আমাকে যেন আসলেই ওলট পালট করে দিল। অথচ বের হইনি মাত্র ৪ দিন। কি অদ্ভুত ব্যাপার। হয়ত এরকম বিরান সময়গুলোর ভার নিতে গিয়ে একা শহরটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। শুধু কি নির্জনতা? রোগ-জরা -মৃত্যু – অভাবের অসহায়ত্বে হয়ত খুব খারাপ দিন যাচ্ছে তার। তারপরও রহস্যময়তার আঁচলে জড়িয়ে সামনে আসতে ভুল করেনি। কয়েকটা ছেঁড়া মেঘ এখনো আকাশে ঝুলে আছে, যেন অনেক কান্নার পরও কিশোরীর মানসরাজ্যের এক কোণে বেঁচে থাকা কিছু অভিমান। মনে হয় যেকোনো মুহুর্তে নেমে আসবে এই নগরীর বুকে। তাহলে বেশ হয়, সবাই ঘুমানোর পর জেগে ওঠা এই এই বিচিত্র শহরটার সাথে বৃষ্টিতে ভেজা যাবে। বৃষ্টিতে ভেজার কথা মাথায় আসতেই কেন জানি রুপার কথা মনে হল। গতবছর আমাকে খুব আগ্রহের সাথে বলেছিল, রাতে একা একা বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছা ওর অনেকদিনের।আচ্ছা, ওদের বাসায় গিয়ে ওকে এখন ডাকলে কেমন হয়?বৃষ্টি এখনো নামেনি, তবে নামার সব সিগন্যাল পজিটিভ। সব ভয়-ঝুঁকি মাড়িয়ে ও কি এই রাতে বের হবে? আচ্ছা ও কেন আনার জ্বরের কথা শুনে খুট করে ফোন রেখে দিয়েছিল, বাদল যেভাবে বলল? কিছু বলার ছিল না তাই? না অভিমান? এটাতে অভিমান করার কি আছে? তাছাড়া আমার ওপর অভিমান করার মত আপন তো আমি না? কী আশ্চর্য! মাথায় এভাবে কেন রুপার ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে?!
মহাপুরুষ বানানোর কারখানার চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমার বাবার নীতিমালার একটা অংশ মাথায় ভাসছে,
মমতা ও মানবস্মৃতি
মনুষ্যজাতি প্রচন্ডরকমের বিস্মৃতিপ্রবণ। মমতা বা আবেগের বিষয় সম্বলিত ঘটনা সমূহ সম্পর্কে বিস্মৃত হইতে তাহাদিগের তেমন সময় লাগে না। তাহারা অপরের প্রতি নিজস্বমায়ার প্রদর্শন গুলো মনে রাখিয়া দেয় ঠিকই, কিন্তু তাহাদিগের প্রতি কৃত মমতার নিদর্শন বরাবরই ভুলিয়া যায়। বাবা হিমালয়, তুমি সর্বদা সচেতন থাকিবে এই মর্মে যে স্মৃতিতে অপরের ভালবাসার ছোঁয়া উজ্জ্বল রাখিতে হইবে, আপনার দ্বারাকৃত মায়া সম্বন্ধে বিস্মৃত হইলেও তেমন সমস্যা নাই।
আমার ভিতর তিনি এখন উঁকি দিলে বোধ হয় হতাশ হতেন না; ঘুরে ফিরে বাদল, রুপা, মেজ ফুপু, বস্তা ভাই ও সুলায়মান সহ অনেকের কথা মাথায় ঘুরছে।একদম অজানা কোনসব কারণে এই মানুষগুলো আমার প্রতি অসামান্য মমতার পরিচয় দিয়েছেন, আমি সম্ভবত তার বিন্দু মাত্রও বিনিময়ে দিতে পারিনি। এভাবেই থাকুক সব, সবকিছুর প্রতিদান দেয়া গেলে ভালবাসা, মায়ার মত জিনিসগুলো হয়ত তাদের বিশেষত্বই হারিয়ে ফেলত।
আস্তে করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটটা পার হতেই কাঠগোলাপের মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিল। কি কাকতালীয়! শাহবাগের মোড়ের ফুলের দোকানগুলো পার হওয়ার সময় যে তিনটা ফুলের নাম মাথায় ঘুরছিল – জুই, কাঠগোলাপ আর মাধবীলতা । যেন অনেকদিন পর দেখা করতে আসা কোন সুজনকে গাছগুলো স্বাগত জানাল । বুকভরে ফুলের ঘ্রাণ টেনে নিয়ে ধন্যবাদ দিলাম গায়ে আবছা আলো মেখে আর একরাশ আঁধার মেখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা কাঠগোলাপের সারিকে।এখানে কিছুক্ষণ দাড়াব না সোজা ভেতরে হাটা দেব, দোটানায় ভুগছি, এমন সময় আমার সামনে এসে একমুঠো জুই ফুল দাঁড়াল।
আফনে ভিতরে যাইবেন? – জুইফুলের গলায় হালকা কৌতুহল।
হুম… ঠিক করতে পারছি না। তুমিই বল কি করা যায়।
আমার লগে আহেন, ভিতরে যাই।
নিশিকন্যার গলার কৌতুহলে আগ্রহ মেশার গন্ধ টের পেতেই আমিও ওর সাথে হাঁটা দিলাম।
তোমার নাম কি গো?
আইজকার জন্য, ধরেন গিয়া হাসনাহেনা।
বলেই মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে এক ফোঁটা জোনাকির মত আলো ছড়িয়ে দিল। হাসিটা পুরো কায়ানাত থামিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
তবুও তার পেছনে লুকিয়ে থাকা অসহায়ত্বের বেদনায় তা দপ করে মুছে গেল।
দিনকাল কেমন যাচ্ছে, হাসনাহেনা?
যায় কুনো রকমে। বাইচ্চা আসি এই আরকি।মরণ ছাড়া কপাল লইয়া আইসিলাম কিনা।
ত্রাণ পাও, না, আগের জমান টাকায় চলছে?
আমরার আর ত্রাণ! কেউ খবরই নেয় না। আমগো কাসে আর কে আইব এই দুরদিনে। আফনের পাঞ্জাবিটা ছিঁড়া ক্যান?
বুঝুতে পারলাম, এই লকডাউনের দিনাতিপাত নিয়ে তেমন কিছু বলতে চায় না। এই না চাওয়ার জন্য মনে হয় আমরাই দায়ী, আমাদেরই চিরায়ত অপমান আর অগ্রহনযোগ্যতায় হয়ত এদের কথা বলার ইচ্ছাটা মারা যায়।
কইলেন না পাঞ্জাবি ছিঁড়সে কেমনে?
বন্ধুর সাথে দেখা করার অপরাধে পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়েছি, রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বললাম।
মানে? বলতে বলতে দেবদারুর ঝাড়ের নিচে বসে পড়ল হাসনাহেনা।
আবার হাসলাম আমি।জিজ্ঞেস করলাম, হাসনাহেনা, তোমার বাসা কোথায়?
এই তো, পারকের পিছের ঝুপড়িতে। আফনে যাইবেন?এইহানেই বসেন না, একটু গপসপ করি।
এবারের হাসিটা অনেক কষ্টে মুখে টানলাম।বললাম, আমি আরেকটু ভেতর থেকে হেটে আসি, কেমন?তুমি বৃষ্টি এলে বাড়ি চলে যেয়।
আইচ্ছা, নিতান্ত হতাশার সাথে রাজি হল নিশিকন্যা।হতাশার সাথে ওর দীর্ঘশ্বাসটাও কানে এসে বাজল।
মাথা নিচু করে উল্টা ঘুরে হাটা দিলাম আমি।পার্কের আরো ভেতরে যেতে হবে। কি অদ্ভুত পৃথিবী! আমার তাড়াতাড়ি চলে আসার কারণটা হাসনাহেনা নামের মেয়েটা কখনো জানবে না।প্রত্যেকবার এর মত নিজের ভাগ্যের প্রতি ধিককার আর অনিশ্চয়তা নিয়ে ফিরে যাবে ওর ঝুপড়ি ঘরটাতে। হয়ত এই শহরের উপর কিছুটা অভিমান ও সাথে নিয়ে। আমার চোখের কোণা থেকে নেমে আসা অশ্রুবিন্দুগুলো ওর অজান্তেই ঝরতে থাকবে।গাল বেয়ে নামবে, তারপর থুতনি থেকে গড়িয়ে টুপ করে মাটিতে মিশে যাবে সারাজীবনএর জন্যে।
হিমালয়, বাবা তুই কাদছিস? আমার বাবা আমার পাশে পাশে হাটছেন।
হু..
আমি না তোকে না কাঁদার শিক্ষা দিয়েছিলাম? বাবা আমার, বলেছিলাম সব আবেগ অনুভূতি মায়া এসবই মোহ ছাড়া আর কিছুই নয়।
কিন্তু কিছু কথা বাকি রয়ে গেছে রে, যাদের জন্য কেউ কাদে না, তাদের জন্যে আমাদের কাদতে হয়।কান্না কিছুই পাল্টায় না, কিন্তু মনে রাখিস, জগতে সবাই নিজের জন্যে কয়েকটা অশ্রুর অধিকার নিয়ে জন্মায়। হাসনাহেনা মেয়েটার জন্য কাঁদলে তুই কাঁদ বাবা, বুক উজাড় করে কাঁদ।ওদের জন্যে আর কেউ কাঁদে না রে। আয় বাবা, আমার কাছে আয়।
মাথা নিচু করে আরো এগিয়ে আসি আমি আমার বাবার দিকে, আমার বাবার ছায়ার দিকে।আমাদের ছায়া মিলে এক হতে থাকে; যেমনটা আমার চোখের পানির সাথে মিশে যেতে থাকে বৃষ্টির অঝোর ধারা।
হ্যাঁ, আবার বৃষ্টি নেমেছে। চুপচাপ ভিজে যেতে থাকে রাতজাগা শহরটা, অবিশ্রান্ত।
More From Author
- None Found
What’s your Reaction?
+1
23
+1
10
+1
1
+1
+1
+1
+1
1