হিমু, বিসিএস এবং কোয়ারেন্টাইন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির চেহারা মনে করার চেষ্টা করছিলাম।চায়ের টঙ,রফিক মামার কড়া লিকারের চা,ছাত্র/ছাত্রীদের এখানে ওখানে পায়চারি।কিন্তু পরিষ্কার কিছুই মাথায় আসছে না।আউট অফ সাইট,আউট অফ মাইন্ড।ইংরেজগুলোর মাথায় আসলেই বুদ্ধি আছে।নাইলে এইরকম জিনিস কেউ বলতে পারে?
এই হিমালয়!তুই কথা শুনছিস আমার?
খালু,আপনার কথা কেউ না শুনে থাকতে পারে?আপনি গুরুজন।গুরুজনের কথাই সিদ্ধ।
খালু খুশি হয়ে গেলেন।কিছু মানুষ অল্পতেই খুশি হয়।তাদের চিন্তাগুলো সরল।আবার তাদের কষ্টবোধও প্রবল।বিধির বিধান এত বৈচিত্র্যময় কেন কে জানে!
হিমালয়,চিন্তা করছি কোয়ারেন্টাইন শেষ হলে বুড়িগঙ্গা ঘুরতে যাব।সারাদিন নৌকা ভাড়া নিয়ে নিব।আচ্ছা,হাতে চালায় ওই নৌকা পাওয়া যাবে না?
অবশ্যই পাওয়া যায়, আর দুপুরে আমরা মাঝনদীতে ভাত খাব।সাথে একটা ডিম ভাজি,আর একটু কাঁচামরিচ।সাব্বির ভাইকে বলে রাখব।
সাব্বিরটা কে?
আমার পরিচিত মাঝি।প্রায়ই সাব্বির ভাইয়ের নৌকায় আমি ঘুরে বেড়াই।
আচ্ছা,তুই এইরকম মানুষদের সাথে মিশিস কেমন করে?আমি তো পারি না,ছোট বেলায় হুট করে মিশে যেতাম,এখন পারি না।কেন বলতে পারিস?
খালু,আপনি এখন বিল্ডিংয়ের মানুষ,তাই হয়তো।
বিল্ডিংয়ের মানুষটা আবার কি?!
খালু,যারা গরিব,তাদের আপন হওয়া ধনীদের জন্য কষ্টকর।কারণ তাদের মতে,ধনীদের সব কাজই স্বার্থের জন্যে।আর ধনীরা বড় বড় বাড়িতে থাকে বলে তাদের বিল্ডিংয়ের মানুষ বলে।আমার কাপড় দেখে তারা মনে করে আমি তাদেরই একজন,আমাকে আপন করে নেয়।
তা তো হবেই,কতবার বললাম ভালো কাপড় কিনে নে।তা তো নিবি না,কোয়ারেন্টাইন দেখে ঘরে রেখেছি। নাইলে ঘর থেকে বের করে দিতাম।মাজেদা খালা এতক্ষণ ধরে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।কিন্ত আমার ময়লা কাপড় এর সাফাই গাওয়া তার কখনোই সহ্য হয়নি বলে ঘরে ঢুকে আমাকে ধমক দিচ্ছেন।
খালা,তুমি আমাকে কখনোই বের করবে না।আমি জানি।
ঘোড়া জানিস তুই!আর তুমি ওকে নিয়ে গল্প করছ কেন?ওর না বিসিএস এর জন্য পড়ার কথা!
খালু কাচুমাচু হয়ে গেলেন।এই ঘরের মাথা মাজেদা খালা।খালু,লিমা আর নাহিদকে তার কথা মেনে চলতে হয়।পৃথিবীর কিছু মানুষ আবার জন্মগত নেতৃত্ব নিয়ে জন্মায়,মাজেদা খালার মতো।খালার স্বামী,সন্তান,তার বন্ধুমহল এবং আশে পাশের সবাই তাকে মেনে চলে।একমাত্র ব্যতিক্রম তার বোনের ছেলে,হিমালয় বা হিমু।সেটা আমি।আর হয়তো পৃথিবীতে তাই আমি তার প্রিয় মানুষ।খালা কখনোই সেটা বলেন না।মানুষের ভালোবাসা অনেকভাবেই প্রকাশ পায়,অনেকেই হয়তো তা ধরতে পারে না।
খালার একমাত্র ইচ্ছা আমি বিসিএস ক্যাডার হবো।এর আগে দুই বার পরীক্ষা দিয়েছি কিন্তু কিছুই হয় নি।ভার্সিটিতে খালা নিজেই গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দিয়ে আসেন।তার কথা একটাই,সবাই লাইব্রেরিতে পড়ে,তুইও পড়।আর যাতে নেয়ার সময় তোকে গেটে পাই।কিন্তু একদিনও আমাকে খালা গেটে পাননি।
তোর সাথে আমি কথা বলব না,তুই আজকে গাড়িতে উঠবি না। তোর সাথে আমার সম্পর্ক শেষ।এই অভিমান বড়জোর এক ঘন্টা ঠেকে।কিছুক্ষণ পড়েই ক্যাম্পাসে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলাকে ঘুরতে দেখা যায়। সবার কাছে তার একটাই কথা।আপনারা একটা হলুদ পাঞ্জাবি পড়া ছেলেকে দেখেছেন?ওকে খুঁজে পাচ্ছি না!
খালা এমনই।কোয়ারেন্টাইন শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে খালার বাসায় আসি আমি।লকডাউন শুরু হওয়ায় খালা আমাকে যেতে দেননি।যদিও নাহিদ আমাকে বলেছে অন্য কথা।খালা নাকি পাড়ার টহল দেয়া পুলিশদেরকে বলেছেন আমাকে যাতে কোথাও যেতে না দেয়া হয়।গত দুই মাস ধরে তাই আমি খালার বাসায়।সকালে উঠে নিয়ম করে খালুর সাথে গল্প করি,খালা এসে সেই আড্ডা ভেঙে দেন।আমাকে পড়তে বসান।বিসিএস এর অনেকগুলো বই আছে।লিমার কথা অনুযায়ী, খালা যখনই লকডাউনের খবর শুনলেন,তিনি গাড়ি নিয়ে নীলক্ষেতে চলে গেলেন।এবং একগাদা বই নিয়ে ফিরলেন।সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলেন যে হিমালয় বিসিএস এর জন্য মন দিয়ে পড়বে।এবং তাকে নাকি এই বলে কথা দিয়েছে।আর তাই তিনি আমার জন্য একটা রুম খালি করে দিলেন।
আমাকে তাই খালার জন্যে বসে থাকতে হয় টেবিলে।খালু নিয়ম করে উপদেশ দিতে আসেন।খালার নির্দেশ।আড়ালে খালা দাঁড়িয়ে থাকেন যাতে খালু আমার সাথে গল্প না করেন।লিমা আর নাহিদ আসে আমাকে দেখতে।অনেকটা চিড়িয়াখানায় নতুন কোন প্রাণী দেখতে আসা।
হিমু ভাইয়া,তোমাকে না পড়ার টেবিলে অনেক মানায়,লিমা হাসতে হাসতে বলে।নাহিদ দাঁত বের করে বড় বোনের সাথে একমত পোষণ করে।
মাসুদ কে রে,লিমা?আমি নিরীহভাবে বলি।লিমার মুখে প্রথম দিন অবিশ্বাসের ছাপ দেখা গেলেও এখন লিমার মুখ লাল হয়ে যায়।লিমা ভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।প্রায়ই মাসুদ নামের একটা ছেলের সাথে গল্প করতে দেখা যায়।যদিও লিমা জানে না যে মাসুদ আমার ভক্ত আর মাসুদ জানে না লিমা আমার আত্নীয়। নাহিদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লিমার দিকে তাকায়।লিমা খেপে গিয়ে বলে,ভাইয়া,তোমার সাথে আর কথা বলব না।এই অভিমানও কয়েক ঘন্টার বেশি ঠেকে না।রাতে খাওয়ার সময় খালাকে বলে,আম্মা,হিমু ভাইয়া আজকে না অনেক কষ্ট করেছে।সারাদিন ধরে এক পাতা খুলে বসেছিল।হাসতে হাসতে তার মুখ থেকে খাবার পড়ে যায়।তার সাথে যোগ দেয় খালু আর নাহিদ।শুধু খালা ক্ষেপে গিয়ে বলেন,হিমু,আজকে এইখানে তোর শেষ রাত।কালকে সকালে যাতে তোকে আমার চোখের সামনে না দেখি।
সকালে সবার আগে ঘুম ভাঙে মাজেদা খালার।তাই আমার আর যাওয়া হয় না।কোয়ারেন্টাইন শেষ হওয়ার আশায় আমি আরো একটা দিন কাটিয়ে দেই।
More From Author
- None Found