সিন্ধু সভ্যতা ও ভারতীয় সমাজ
আনুমানিক প্রায় ৪৫০০ থেকে ৫০০০ বছর আগে সিন্ধুসভ্যতার অস্তিত্ব ছিল বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২২ -২৩ খৃষ্টাব্দে এই পুরাতন সভ্যতা আবিস্কার করেন। মহেঞ্জোদারো প্রথমে ও হরপ্পা পরে আবিস্কৃত হয় । পরে পরে আরও বহু জায়গায় সিন্ধুসভ্যতার নিদর্শন মেলে। গুজরাটের লোঠাল থেকে আরম্ভ করে পূর্বে পশ্চিমবঙ্গ পর্য্যন্ত অনেক জায়গায় এই সভ্যতার চিহ্ন দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে এক বিরাট এলাকা (মোটামুটি প্রায় ৫ লক্ষ বর্মাইল) জুড়ে এই সভ্যতার বিস্তার ছিল।
সিন্ধুসভ্যতা ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরানো সভ্যতা। মধ্য এশিয়ার কোনো অঞ্চল থেকে আর্য্যজাতির এদেশে আসার আগে সিন্ধুসভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। ভারতীয় সমাজে সিন্ধুসভ্যতার যথেষ্ট প্রভাব আজও বর্তমান।
সিন্ধুসভ্যতার মানুষদের আর্য্যরা “অনার্য্য” বলে অভিহিত করতো। প্রকৃতপক্ষে, এই অনার্য্যরাই হোলো ভারতের আদি অধিবাসী। পণ্ডিতদের মতে ভারতের এই আদি বাসিন্দারা মূলতঃ ছিলো বণিক। তারা নগরনির্মাণে দক্ষ ছিলো। তাদের সভ্যতা ছিলো নগরকেন্দ্রিক । নগরগুলির পরিকল্পনা আজও বিশেষজ্ঞদের বিস্ময় উদ্রেক করে । সুদূর অতীতে এত সুচারু পরিকল্পনা যারা করতে পেরেছিলো তাদের ব্যবহারিক বিজ্ঞানে অবশ্যই যথেষ্ট পারদর্শিতা ছিলো। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিলো। হাতের কাজে তাদের বিশেষ দক্ষতা ছিলো ।এর প্রমাণ পাওয়া যায় লিপিযুক্ত নরম পাথরের সীলমোহর ও হাতের তাবিজ নির্মাণে, কণ্ঠহারের গুটি তৈরিতে, পাথরের ও ধাতুর তৈরি ভাস্কর্য্যে, বস্ত্র বয়ন প্রভৃতিতে ।
আর্য্যরা এসেছিলো মধ্য এশিয়ার কোনো অঞ্চল থেকে। পণ্ডিতদের ধারণা কোনো বিশেষ অবস্থা বিপর্যয়ের জন্যই তাদের নিজেদের বাসভবন ছেড়ে অন্য বাসভূমির খোঁজে বেরোতে হয়েছিলো। কি সেই বিপর্যয় তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যাই হোক, এই আর্য্যরা ছিলো মূলতঃ পশু শিকারী ও পশুপালক । এরা গ্রামে বাস করতো। নগরনির্মাণ এদের করায়ত্ত্ব ছিলো না। প্রথমদিকে আর্য্যদের সঙ্গে অনার্য্যদের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকতো। আর্য্যরা অনার্য্যদের নগরগুলি ধ্বংস করার চেষ্টা করতো এবং করতোও। তাই তাদের নেতার আর এক নাম ছিলো “পুরন্দর” (ইন্দ্র) অর্থাৎ নগর বা দুর্গ ধ্বংশকারী। প্রকৃতপক্ষে, আর্য্যদের প্রথম ধর্মগ্রন্থ ঋকবেদে বহুস্থানে দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনায় শত্রুনিধন করে শত্রুদের সম্পদ তাদের দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের ধারণা সিন্ধুসভ্যতার অবসানের পেছনে আর্য্যদের বহিরাক্রমণ অন্যতম কারণ।
ধীরে ধীরে আর্য্য ও অনার্য্যদের মধ্যে আদানপ্রদান হতে শুরু হোলো । অবশ্যই সেটা দু-এক বছর বা দশকে হয়নি। সামাজিক প্রয়োজন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তা ধীরে ধীরে আপন নিয়মে ঘটেছিলো। আর্য্যরা , যে কোনো কারণেই হোক, নিজেদের বাসভূমি ত্যাগ করে আসার সময়ে নিজেদের সঙ্গে যথেষ্ট সংখ্যায় তাদের স্ত্রীলোকদের নিয়ে আসতে পারেনি। ফলে পরবর্তী সময়ে , বংশরক্ষার প্রয়োজনে তাদের অনার্য্য স্ত্রীলোকের পাণিগ্রহণ করতে হয়েছিলো , যদিও অনার্য্যদের তারা নিজেদের সমকক্ষ বলে মনে করতো না। ঋকবেদে স্ত্রীধন পাওয়ার জন্যও প্রার্থনা করা হয়েছে।প্রথম প্রথম তার মধ্যে বলপ্রয়োগের প্রাবল্য ছিল। প্রকৃতপক্ষে, বধূ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে যাকে বহন করে আনা হয়েছে । এই প্রথাকেই রাক্ষসবিবাহ নাম দিয়ে তাকে সামাজিক মান্যতা দেওয়া হয়েছিলো। যখন অনার্য্যরমণী আর্য্যগৃহে গৃহিণী হলেন, তার প্রভাব অবশ্যম্ভাবীভাবে আর্য্যসমাজে ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে লাগলো । প্রথম প্রথম ধীরগতিতে হলেও পরে তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতগতিতে ঘটতে লাগলো । অনার্য্যরমণীর আর্য্যগৃহে গৃহিণী হয়ে পদার্পনের একটি প্রমাণ হোলো “ আর্য্যপুত্র “ শব্দটি । অনার্য্যরমণী স্বামীগৃহে আর্য্য পতিকে এই সম্বোধন করতেন । নতুবা স্বামীকে আর্য্যপুত্র বলে সম্বোধন করাটা যুক্তিগ্রাহ্য উপায়ে ব্যাখ্যা করা যায় না । ( কোনো বাঙ্গালী গৃহিণী তার বাঙ্গালী স্বামীকে বা কোনো ইংরাজ মহিলা তার ইংরাজ স্বামীকে বাঙ্গালীর ছেলে অথবা ইংরাজের ছেলে বলে সম্বোধন করবে না ) প্রকৃতপক্ষে, আর্য্যদের তিনটি অভাব ছিলো —— স্ত্রীলোক, অন্ন আর ধন —— ঋকবেদের প্রার্থনাগুলি থেকে তা বোঝা যায় । তাই তারা সিন্ধুসভ্যতার নগরগুলি আক্রমণ ও লুণ্ঠন করবার চেষ্টা করতো। সিন্ধুসভ্যতার মানুষরা ছিলো বণিক আর তাদের অশ্ব ছিলোনা , অপরদিকে আর্য্যরা ছিলো যোদ্ধা জাত । তাদের অশ্ববাহী রথের সামনে তথাকথিত অনার্য্যদের হারস্বীকার করতে হয়েছিলো ।( একই ঘটনা ঘটেছিলো আমেরিকা মহাদেশে যখন অশ্বারোহী স্পেনীয়রা ওখানকার আদি সভ্যতার মানুষগুলোকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলো ।) কিন্ত্ত সভ্যতার মাপকাঠিতে অনার্য্যরা ছিলো উন্নততর। তবে সিন্ধুসভ্যতার মানুষরা বৈষয়িক ব্যাপারে আর্য্যদের অপেক্ষা উন্নত হলেও প্রজ্ঞার দিক থেকে তারা তাদের সমকক্ষ ছিলোনা । আর্য্যদের ভাষা এত উন্নত ছিলো যে একমাত্র এই ভাষাতেই উচ্চ সূক্ষ চিন্তা সম্ভবপর ছিলো । ফলে এই ভাষাতেই পরবর্তীকালেই সাহিত্যসমূহ রচিত হয়েছিলো ।
শিল্পকলা, ব্যবসাবাণিজ্য, কৃষি উৎপাদন ও শষ্য সংরক্ষণ, নগর পরিকল্পনা ও নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সিন্ধুসভ্যতার মানুষরা আর্য্যদের অপেক্ষা অনেক পারদর্শী ছিলো । অবশ্য, আর্য্যরা তাদের অবজ্ঞাসূচক কয়েকটি নাম দিয়েছিলো ।তাদের উদ্দেশ্যে অসুর, দস্যু, দাস, পণি ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে । আর্য্যদের গাভী ছিলোনা । গাভী বৈদিক যুগে সম্পদ হিসাবে গণ্য হোতো । গোধন লাভ করাও অনেক সময়ে আর্য্যদের দ্বারা সিন্ধুসভ্যতার নগরগুলিকে আক্রমণ করার একটি উদ্দেশ্য হয়ে উঠতো ।
যাই হোক, প্রয়োজনে বা সামাজিক প্রক্রিয়ায়, আর্য্যসভ্যতা তথাকথিত অনার্য্য (সিন্ধু)সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকলো । অন্যান্য প্রাচীন কিছু জনগোষ্ঠীর মতো বৈদিক আর্য্যরাও বিভিন্ন পুরুষ দেবতার উপাসনা করতো । এনারা মূলতঃ বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক ছিলেন ।যথা বরুণ (জল), পবন (বায়ু), সূর্য্য, ইন্দ্র (বৃষ্টি) অগ্নি ইত্যাদি । যদিও এঁদের স্ত্রীরূপে স্ত্রী দেবতারাও ছিলেন, তবে তাঁদের ভূমিকা ছিলো গৌণ । সিন্ধুসভ্যতার প্রভাবে স্ত্রীদেবতারা সমাজে বিশেষ স্থান লাভ করলেন । মনসা, শীতলা, লক্ষী(শ্রী) ইত্যাদি দেবীরা সামনে এলেন । দেবী দুর্গা স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করলেন । পুরুষদেবতা শিব , যিনি আদতে অনার্য্যদেবতা, শ্মশানে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান, তিনি ত্রিদেবতার মধ্যে স্থান পেলেন ।সমাজে শিল্পকলার প্রসারলাভ হোলো ।আর্য্যরা প্রথমে যে জায়গায় এসেছিলো, সেই পাঞ্জাব অঞ্চলে আর্য্যযুগের কোনো শিল্পের নিদর্শণ পাওয়া যায়নি ।পরবর্তীকালে সমাজে শিল্পকলা ঔৎকর্ষ লাভ করছিলো । পরবর্তীকালে বহু বিচিত্র সুন্দর নগরীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমরা সকলেই অবগত । পণ্ডিতদের মতে এসবই আর্য্যসভ্যতার সঙ্গে প্রাচীন সিন্ধুসভ্যতার সংমিশ্রণের ফল ।প্রখ্যাত নৃতত্ববিদ ডঃ অতুল সুরের মতে বর্তমান ভারতীয় সভ্যতার চার আনা আর্য্যসভ্যতার দান আর বারো আনা অনার্য্য সভ্যতার ।
More From Author
- None Found